Kojagori Lakshmi Puja Purnima

কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো এবং বাঙালির ব্রতকথা

দেবী লক্ষ্মীর স্বরূপ এবং তার ক্রমবিবর্তন পুরোপুরি বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। শ্রী এবং শ্রীহীনতা, লক্ষ্মীর আবির্ভাব আর অলক্ষ্মীর প্রকোপের কাহিনী হাজার হাজার বছরের পরম্পরায় বেদ, ব্রাহ্মণগ্রন্থ, মহাকাব্য, পুরাণের পথ অতিক্রম করে আজকের যুগের পাঁচালীতে উঠে এসেছে।

পাঁচালীতে লক্ষ্মীদেবীর ছবি।
সুচেতা বন্দ্যোপাধ্যায়
  • শেষ আপডেট:০৫ অক্টোবর ২০২৫ ১০:২২

প্রথম পর্ব

আমাদের বাড়িতে যে মা লক্ষ্মীর পাঁচালীখানা আছে, সে আমার ঠাকুমার আমলের। পাঁচালীটা কে কবে কোথা থেকে কিনেছিলেন জানি না, তবে বর্ধমানের মেয়ে আমার ঠাকুমা বর্ধমানের পল্লীগ্রামের যে গৃহস্থালীতে নববধূ হয়ে  প্রবেশ করেছিলেন, সেখানে এই পাঁচালীটি খানিক বেমানান। কারণ আমার ঠাকুমা বধর্মানের ‘ঘটি’ সংসারের প্রথম ‘বাঙাল’ সদস্য, এই পাঁচালীর রচয়িতা জনৈক নাম না জানা বরিশালনিবাসী ব্রাহ্মণ।

আমার ঠাকুমা যখন নববধূ ছিলেন, তখন হয়তো সংসারের সুখ-সমৃদ্ধির কামনায় প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় লক্ষ্মীর ঘটের সামনে এই ব্রতকথা পড়তেন সুর করে। তবে আজ অনেক বছর পরে বর্ধমান থেকে কলকাতায় স্থানান্তরিত আমাদের পরিবারে অন্য অনেক বাড়ির মতোই কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিনে এই জরাজীর্ণ রোগাপাতলা পাঁচালীটির খোঁজ পড়ে। এখন বাড়ির গৃহিণী আমার মা লক্ষ্মীপুজোর দিন সন্ধ্যায় সুর করে পড়েন –

দোল পূর্ণিমার নিশা নির্মল আকাশ।
মন্দ মন্দ বহিতেছে মলয় বাতাস।।
গোলোকে কমলা সহ বসি নারায়ণ।
করিতেছে নানা কথা সুখে আলাপন।। …

আমি ছোটবেলায় অবাক হয়ে ভাবতাম, এই যে লক্ষ্মীব্রত অবন্তীনগরে প্রচারিত হল, সেটা তো প্রতি গুরুবারে পালন করার কথা, তার বদলে বছরে একদিন, কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোয়, যেটা প্রতিবছর গুরুবারে হয়ও না – সেদিন ব্রতকথা পড়লে কি ফল হয়? আরও কত বিস্ময় ছিল সেই আশি বছরের বেশি পুরোনো পাঁচালীতে। আমাদের বাড়ির সিমেন্টের মেঝেতে যে আমার মা ‘ভোরে উঠে নাহি দেয় গোবরের ছড়া’, তাতে সত্যিই দোষ হয় কিনা, সেমিজ পরলে সত্যিই মা লক্ষ্মী রাগ করেন কিনা (আমার ঠাকুমার পাঁচালীতে লেখা আছে), এত জায়গা থাকতে দেবী শুধুমাত্র অবন্তীনগরে এসে ব্রতের প্রচার করেন কেন? আর অবন্তী যদি মধ্যপ্রদেশে হয় তাহলে সেখানে গিয়ে দেবী বাংলায় কথা বলেন কেন?

‘সাত পুত্র সাত হাঁড়ি’ যদি এত খারাপ ব্যাপার তাহলে আমার নিজের পরিবারে এবং অনেক আত্মীয়ের বাড়িতে ‘হাঁড়ি আলাদা’ হলে লোকে দুঃখ পায় না কেন (তখন ‘হাঁড়ি আলাদা’ কথাটা নতুন শিখেছিলাম)? অতি দরিদ্র অবস্থায় না পড়লে লোকে লক্ষ্মীপুজো করে না কেন? লক্ষ্মী যদি টাকাপয়সার দেবীই হবেন তবে পাঁচালীর গল্পে যে ধনী ব্যবসায়ীর কথা থাকে সে “যাহার অভাব আছে সে পূজে উহারে” বলে অবজ্ঞা করে কেন? আর গোড়া থেকে যদি অবজ্ঞা করছিলই তাহলে এতদিন তার সপ্তডিঙ্গা জলে ডোবেনি কেন, অবন্তীনগরে এসে লক্ষ্মীব্রত দেখে বিরক্ত হবার পরেই বা ডুবল কেন? এইসব বিচিত্র ভাবনায় আমার ছোটবেলা কেটেছে। সব মিলিয়ে সেই ছোটবেলা থেকেই লক্ষ্মী আমার কাছে এক পরম রহস্যময়ী দেবী হয়ে উঠেছিলেন।

আপনারা হয়তো ভাবছেন, পুরাণ মহাভারত ছেড়ে আমি হঠাৎ পাঁচালী থেকে শুরু করলাম কেন? ধরে নিন প্রথম কারণ এই যে, এই পাঁচালী আমার শৈশবের অনেকখানি জুড়ে আছে আর মাথার অর্ধেক চুল পেকে গেলে মানুষ স্মৃতিমেদুর হতে ভালোবাসে কারণে হোক বা অকারণে। আর দ্বিতীয় কারণ বোধহয় এই যে, বড় হয়ে পুরাণচর্চা করতে বসে অন্যান্য দেবদেবীদের মাঝে সম্পদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শ্রী বা লক্ষ্মীর যে স্বতন্ত্র বিকাশ লক্ষ্য করেছি, যে বৈপরীত্যের মাঝে তাঁর স্বরূপ ধীরে ধীরে নির্মিত হতে দেখেছি বৈদিক কাল থেকে পুরাণের যুগ পেরিয়ে, আর তার ছাপ আমাদের জীবনে যেভাবে রয়ে গিয়েছে, সেখানে এই পাঁচালীর প্রভাব বড় কম নয়। 

সত্যি বলতে কী, অন্য অনেক ঠাকুর দেবতার পাঁচালী কিনতে পাওয়া যায়, সেই পাঁচালী বা ব্রতকথার সঙ্গে অনেক সময়ই সেই দেবতার পৌরাণিক বা বৈদিক স্বরূপের মিল তেমন থাকে না। কিন্তু মা লক্ষ্মীর দেবীস্বরূপে আত্মপ্রকাশের সময় থেকে আজকের দিনে ব্রতকথায় তাঁর মাহাত্ম্য যেমনটি পাই, তাতে শুধু যে তেমন পার্থক্য নেই তা নয়, সম্পদ-সমৃদ্ধি সম্পর্কে মানুষের চিরন্তন ভাবনার বাস্তব দিকটি তা এমন ভাবেই তুলে ধরে যে, আমার নিজের মনে হয় যদি পাঁচালীর উপাখ্যান বাদ দিই তাহলে দেবী লক্ষ্মীর স্বরূপ এবং তার ক্রমবিবর্তন পুরোপুরি বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। শ্রী এবং শ্রীহীনতা, লক্ষ্মীর আবির্ভাব আর অলক্ষ্মীর প্রকোপের কাহিনী হাজার হাজার বছরের পরম্পরায় বেদ, ব্রাহ্মণগ্রন্থ, মহাকাব্য, পুরাণের পথ অতিক্রম করে আজকের যুগের পাঁচালীতে উঠে এসেছে। (ক্রমশ)

(লেখিকা পুরাণ গবেষক)


Share