Maa Durga at Kolkata

দেবী দুর্গার রূপ ও কলকাতার থিম পুজো!

আজকের কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ দূর্গাপুজোর ধরন দেখে বেদ ও পুরাণে বর্ণিত দেবীরূপের কোনও মিল পাই না। দুর্গাপুজোকে আমোদপ্রেমীরা উৎসব মনে করতেই পারেন। তবে এটি হিন্দু বা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে পুরোদস্তুর ধর্মীয় অনুষ্ঠান। কমিউনিস্টরা নানা কৌশলে সেই ধর্মীয় ভাবাবেগকে আঘাত করে থাকে। কখনও দূর্গাপুজো না বলে দুর্গোৎসব বা শারদীয়া বলে চালিয়ে দেয়। নানা ভাবে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক বিষয়টিকে লঘু করার চেষ্টা চালানো হয়।

মা দুর্গা।
দিবাকর রায়
  • শেষ আপডেট:২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৬:২১

সনাতন ধর্মের অনুযায়ীদের কাছে শক্তি আরাধনার সর্বপ্রাচীন উল্লেখ রয়েছে ঋকবেদে। পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋকবেদের দশম মণ্ডলে ১২৫ সূক্তে শক্তিকে ব্রহ্মময়ী মা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। ঋকবেদের এই সূক্তে মোট আটটি শ্লোক রয়েছে। এই সূক্ত থেকেই আদতে শক্তির আরাধনা শুরু হয় বলেই পণ্ডিতেরা মনে করেন। এটি ঋষি অম্ভৃণের কন্যা বাক দ্বারা সৃষ্ট। প্রথম এবং তৃতীয় থেকে অষ্টম শ্লোক ত্রিষ্টুপ ছন্দে রচিত। কেবল দ্বিতীয় সূক্তটি জগতী ছন্দে রচিত। আত্মাকে উৎসর্গীকৃত এই শ্লোকটি ব্রহ্মোপলব্ধির পরই ঋষি কন্যা বাক্‌ দ্বারা রচিত।

এই সূক্ত ধরেই মার্কণ্ডেয় পুরাণে দেবীর বর্ণনা রয়েছে। দেবী দুর্গা যোদ্ধা। তাঁর দশ হাতে দশ অস্ত্র। গায়ের রঙ অতসী পুষ্পের মতো। মার্কণ্ডেয় পুরাণের ৮১ থেকে ৯৩ অধ্যায় পাঠ করে দেখতে পারেন। সেখানে চৈত্র বংশের রাজা সুরথের কাছে মহর্ষি মেধস মহামায়ার রূপ বর্ণনা করেছেন। সেই বর্ণনা দেবীমাহাত্ম্য হিসেবে প্রচলিত। মহর্ষি মেধসের বর্ণিত সেই রূপে দেবীকে পরপর তিন বছর পুজো করে দর্শন লাভ করেছিলেন মহারাজা সুরথ। দেবীর বরে তিনি সূর্যের পুত্র সার্বণী মনু হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও কোন ঋতুতে মহারাজা সুরথ পুজো করেছিলেন তার উল্লেখ নেই। তবুও আশ্বিনের শুক্ল পক্ষকেই দেবীর আরাধনার উপযুক্ত সময় হিসেবে ধরা হয়। মর্যদাপুরুষোত্তম শ্রীরাম এই সময়েই দেবীর পুজো করেছিলেন।

যদিও তার অনেক আগে থেকেই দেবীর ন’টি রূপে পুজো চলে আসছিল। সেই ন’টি রূপের কথা দেব্যুপনিষদ্‌ বা দেবী উপনিষদে বলা হয়েছে। দেব্যুপনিষদ হল হিন্দু ধর্মের অন্যতম অপ্রধান উপনিষদ। যে ১৯টি উপনিষদ অথর্ববেদের সঙ্গে সংযুক্ত, দেব্যুপনিষদ্‌ তার অন্যতম। এটি আটটি শাক্ত উপনিষদেরও অন্যতম উপনিষদ্‌। স্বাভাবিক ভাবেই দেবী দূর্গা বা মহামায়ার গুরুত্ব এবং ব্যপ্তি ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ভাবে অনেক গভীরে। দেবতা ও দেবীদের চেনা যায় তাঁদের রূপ বৈশিষ্ট্য ও আয়ুধ দিয়ে। এ বিষয়ে অষ্টাদশ পুরাণের বিভিন্ন জায়গায় সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে।

আমরা যখন কোনও কিছু সম্পর্কে শব্দের মাধ্যমে জ্ঞানলাভ করি তখন আমাদের মধ্যে কি সেই জিনিসটি কেমন দেখতে সে সম্পর্কে সবসময় ধারণা তৈরি হয়? যেমন যাঁরা হাতি দেখেননি তাঁদের বৰ্ণনা দিতে গেলে হাতির চারটে থামের মতো পা আছে, একটা শুঁড় আছে, সাদা দু’টি দাঁত আছে, পিছনে ছোট লেজ আছে ইত্যাদি বর্ণনা দেওয়া হয়। এতে যিনি দেখেননি তাঁর হাতি সম্পর্কে একটি ধারণা তৈরি হয়। এখন কোনও দেবতা, যাঁকে কেউ চোখে দেখেননি, তাঁকে ধ্যানে দেখতে গেলে অর্থাৎ মনন দিয়ে স্পর্শ করতে গেলে, তাঁর সম্পর্কে যেন সুস্পষ্ট ধারণা তৈরি করতে হয়। যাতে মনের ভিতরে তাঁর নির্দিষ্ট ছবি তৈরি হয়। সেরকম বর্ণনার মন্ত্রই হল ধ্যানমন্ত্র। সোজা বাংলায় দেবদেবীর আরাধনা করতে গেলে তাঁকে কিরকম দেখতে তা না জানলে, তাঁকে হৃদয়ে পাওয়া সম্ভব নয়। কোনও শিশু যদি কখনও তার মাকে না দেখে থাকে, তখন মা কেমন দেখতে ছিল তা জানতে পারবে না। সেই জানানোর জন্যই শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা।

দেবী দুর্গার ধ্যানমন্ত্র কি?

ওঁ জটাজুট সমাযুক্তাং অর্ধেন্দু কৃতশেখরাম্।

লোচনত্রয় সংযুক্তাং পূর্ণেন্দু সদৃশাননাম্।।

অতসী পুষ্প বর্ণাভাং সুপ্রতিষ্ঠাং সুলোচনাম্।

নব যৌবন সম্পনাং সর্ব্বাভরণ ভূষিতাম্।।

সুচারু দশনাং তদ্বৎ পীনোন্নত পয়োধরাম্।

ত্রিভঙ্গ স্থান সংস্থানাং মহিষাসুর মর্দিনীম্।।

মৃণালায়ত সংস্পর্শ দশবাহু সমন্বিতাম্।

ত্রিশূলং দক্ষিণে ধ‍্যেয়ং খড়্গং চক্রং ক্রমাদধঃ।।

তীক্ষ্ণবাণং তথা শক্তিং দক্ষিণেষু বিচিন্তয়েৎ।

খেটকং পূর্ণচাপঞ্চ পাশমঙ্কুশমেব চ।।

ঘন্টাং বা পরশুং বাপি বামতঃ সন্নিবেশয়েৎ।

অধাস্তান মহিষং তদ্বদ্ বিশিরস্কং প্রদর্শয়েৎ।।

শিরশ্ছেদোদ্ভবং তদ্বদ্ দানবং খড়্গ পাণিনম্।

হৃদি শুলেন নির্ভিন্নং নির্যদন্ত্র বিভুষিতম্।।

রক্তারক্তি কৃতাঙ্গঞ্চ রক্ত বিস্ফুরিতে ক্ষণম্।

বেষ্টিতং নাগ পাশেন ভ্রূকুটি ভীষণাননম্।।

সপাশ বামহস্তেন ধৃতকেশন্তু দুর্গয়া।

বমদরুধির বক্তঞ্চ দেব‍্যা সিংহং প্রদর্শয়েৎ।।

দেব‍্যাস্তু দক্ষিণং পাদং সমং সিংহোপরিস্থিতম্।

কিঞ্চিৎ ঊদ্ধং তথা বাম অঙ্গুষ্ঠং মহিষোপরি।।

স্তূয়মানঞ্চ তদ্রূপ মমরৈঃ সন্নিবেশয়েৎ।

প্রসন্ন বদনাং দেবীং সর্ব্ব কাম ফল প্রদাং।।

উগ্রাচন্ডা প্রচন্ডা চ চন্ডোগ্রো চন্ডনায়িকা।

চন্ডা চন্ডবতী চৈব চন্ডরূপাতি চন্ডিকা।।

অষ্টাভি শক্তিভিরষ্টাভিঃ সততং পরিবেষ্টিতাম্।

চিন্তয়েৎজগতাং ধাত্রিং ধর্মকামার্থ মোক্ষদাম্।।

সংস্কৃত এই ধ্যান মন্ত্রের মানে হল, দেবীর মাথায় জটার সাথে অর্ধচন্দ্রের মত কপাল। তাঁর মুখ পূর্ণিমার চাঁদের মতো আর গায়ের রঙ অতসীফুলের মতো। তিনি সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত এবং তাঁর সর্বাঙ্গ বিভিন্ন অলঙ্কার দ্বারা ভূষিত।

তাঁর দাঁত সুন্দর এবং ধারালো, স্তন সম্পূর্ণ। ত্রিভঙ্গে দাঁড়িয়ে তিনি দৈত্য নিধন করছেন। তাঁর দশহাতভর্তি অস্ত্র যা দেখতে শাখা-প্রশাখা সমন্বিত পদ্ম গাছের মতো। ডানদিকের উপরের হাতে অবস্থান করে ত্রিশুল, তারপর ক্রমান্বয়ে খড়গ এবং চক্র।

দেবীর দক্ষিণের সর্বনিম্ন দুই হাতের অস্ত্র ধারালো তীর এবং বর্শা। দেবীর ধ্যানে বর্ণিত হয় তাঁর বাঁ হস্ত। সেদিকে সবচেয়ে নিচের হাতে থাকে চামড়ার ঢাল ও তার উপরের হাতে ধনুক। সেগুলির উপরের হাতে থাকে সর্প, অঙ্কুশ এবং কুঠার (ক্রমান্বয়ে উপরের দিকে)। দেবীর পায়ের কাছে দৈত্যরাজের মাথার স্থান।

মহিষের কাটা মাথা থেকে মহিসাসুরের দেহ অর্ধেক উত্থাপিত, হাতে তাঁর খড়গ এবং হৃদয়ে দেবীর ত্রিশূল দ্বারা বিদ্ধ। তাঁর পেট থেকে নাড়িভূঁড়ি নির্গত হয়েছে। শরীর রক্তলিপ্ত। দেবীর হাতে ধরা সাপ দ্বারা অসুরের দেহ বেষ্টিত। তবে উত্থিত ভ্রূতে দৈত্যের রূপও ভয়ঙ্কর।

দেবী তাঁর বাম হাত দিয়ে দৈত্যরাজের চুল টেনে রেখেছেন। দেবীর ডান পা বাহন সিংহের উপরে এবং বাঁ পা কিঞ্চিৎ ঊর্ধ্বে মহিষের উপরে অবস্থান করে। প্রবল যুদ্ধরত অবস্থাতেও দেবী তাঁর শান্তিপূর্ণ মুখাবয়ব ও আশীর্বাদী রূপ বজায় রেখেছেন এবং সমস্ত দেবতা দেবীর এই রূপের স্তুতি করেন।

দেবীর উপরোক্ত রূপ দেবতাদের আট শক্তি উগ্রচন্ডা, প্রচন্ডা, চন্ডোগ্রা, চন্ডনায়িকা, চন্ডা, চন্ডবতী, চন্ডরূপ ও অতিচন্ডিকা দ্বারা পরিবেষ্টিত। গৃহকর্তার মানব জীবনের সমস্ত ইচ্ছা পূর্ণ করেন এই দেবী। তাই ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ লাভের জন্য জগন্মাতৃকা দেবী দুর্গার ধ্যানই মানবজাতির হওয়া উচিত। এই রূপকেই মৃন্ময়ী মূর্তিতে প্রকাশিত করে বাঙালি দুর্গাপূজা করে আসছে। যা থেকে বাঙালি হিন্দু অনুপ্রেরণা পেয়ে এসেছে দীর্ঘ সময় ধরে।

আজকের কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ দূর্গাপুজোর ধরন দেখে বেদ ও পুরাণে বর্ণিত দেবীরূপের কোনও মিল পাই না। দুর্গাপুজোকে আমোদপ্রেমীরা উৎসব মনে করতেই পারেন। তবে এটি হিন্দু বা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে পুরোদস্তুর ধর্মীয় অনুষ্ঠান। কমিউনিস্টরা নানা কৌশলে সেই ধর্মীয় ভাবাবেগকে আঘাত করে থাকে। কখনও দূর্গাপুজো না বলে দুর্গোৎসব বা শারদীয়া বলে চালিয়ে দেয়। নানা ভাবে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক বিষয়টিকে লঘু করার চেষ্টা চালানো হয়।

সেই কারণে তথাকথিত থিম পুজোতে মাতিয়ে রাখা হয়। কলকাতার জুতোর প্যান্ডেল সেই তালিকায় নয়া সংযোজন। ওই প্যান্ডেল এবং আরও অনেক তথাকথিত থিম পুজোর প্যান্ডেলের মূর্তির সঙ্গে পুরাণে বর্ণিত দেবীরূপের কোনও মিল নেই। দেবীর এমন ‘সাইজ জিরো’ ফিগারও নয়। অস্ত্রবিহীন, মটরশুঁটি বাহন ও অন্যান্য বাহনওয়ালা, লিকপিকে সাইজ জিরো, ফ্যাশনেবল মুর্তিধারী যাদের প্যান্ডেলে রেখে জোর করে দুর্গা বলে চালানোর চেষ্টা হচ্ছে, তাদের পুজো করলে আর যাই হোক কোনও মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে না। রূপ, যশ, জয়, ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ দেবীর কৃপায় সবই লাভ সম্ভব। দেবীর রূপ কল্পনা করতে না পারলে, হৃদয়ে কিছুই অনুভব হবে না, অনুভব না হলে পুজোই বৃথা। লাভের বদলে সব লোকসান।

কথায় কথায় যাঁরা নিজেদের ‘রিলিজিয়াস হিন্দু’ বলে দাবি করে থাকেন তাঁরা এই ধর্মীয় বিকৃতি মেনে নিচ্ছেন কী করে সেটাই বুঝি না!


Share